কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হুন্ডি বন্ধের বছর তথা ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়, রিজার্ভও সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এই স্ফীতির প্রধান কারণ করোনা মহামারির সময় হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়েছিল। করোনা চলে যাওয়ার পরের অর্থবছরে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হয়ে ওঠে। তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলএও) জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্সের ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি ৬০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ নগদ আকারে ও বাকি ৩০ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে। নগদ আকারে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেশ কয়েক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে তার ব্যক্তিগত গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, রেমিট্যান্সের ৪২ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। বাকি ৫৮ শতাংশ আসে ব্যাংকের মাধ্যমে।
সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেছেন, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বেশি আসছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে প্রবাসীরা চলতি মাসের প্রথম ৭ দিনে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। এই হিসাবে প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার। যদিও জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহে দৈনিক রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে পৌনে ৭ কোটি ডলার করে। তার আগের মাস জুনে প্রবাসীরা প্রতিদিন পাঠিয়েছিলেন গড়ে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার করে। ওই মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর সদ্যবিদায়ী আগস্ট মাসে প্রবাসীরা দেশে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ গত মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে আগস্টে। খোলা মুদ্রাবাজারে ডলারের উচ্চ দর থাকায় প্রবাসীদের হুন্ডির মাধ্যমে আয় পাঠানোই- এজন্য দায়ী বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৫৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্টে রেমিট্যান্স (বৈধ চ্যানেলে) এসেছিল প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, গত চার বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় এ বছরের আগস্টেই সর্বনিম্ন পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ৭ দিনে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে ৫৯ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩২ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
সদ্যবিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স, যা সদ্যবিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৫৭ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার কম।
২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার কারণে শুধু যে রিজার্ভের পতন হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। বকেয়া আমদানির বিল পরিশোধ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আগে বিদেশ থেকে আসার পর অনেক ব্যক্তি আমাদের কাছে ডলার বিক্রি করতেন, বর্তমানে তারা আসেন না। এছাড়া রেমিট্যান্স আগের চেয়ে কমেছে। ফলে আগের চেয়ে ব্যাংকে অনেক কম ডলার আসছে। চাহিদা বাড়তে থাকলেও, ব্যাংকের কাছে ডলারের জোগান বাড়েনি। তাই ব্যাংকের পক্ষেও গ্রাহকের চাহিদামতো ডলার সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বাভাবিক রাখতে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে আমদানির দায় হিসেবে ডলার সাশ্রয় হলেও বাস্তবে ডলারের মজুত বাড়ছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৪৩২ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। গত বছরের একই মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৬৩৫ কোটি ডলারের। সে হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত জুলাইয়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংক ও অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জগুলো থেকেও নগদ ডলার সংগ্রহ করা দিনকে দিন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে খোলা মুদ্রাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার নজিরবিহীনভাবে বেড়ে ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এই দাম দেওয়া অনেকেরই ডলার কেনা অসাধ্য হয়ে পড়েছে। নগদ ডলারের দাম কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টার ফলে মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় ডলারের আনুষ্ঠানিক লেনদেনও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে ডলার চাহিদার এই চাপ এসে পড়ছে ক্রেডিট কার্ডের বাজারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশিরা বিদেশে গিয়ে কার্ড ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন করেছেন ৬ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ২ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশে গিয়ে কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রার খরচের প্রবণতা বেড়েছে ১২৭ শতাংশ, যা পরিমাণে ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
এই সময়ে শুধু লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে, তা-ই নয়। বেড়েছে লেনদেনের সংখ্যাও। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট লেনদেন হয়েছে ৯২ লাখ ৩৭ হাজার। এর আগের অর্থবছরে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে লেনদেনের সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ লাখ ৪৭ হাজার। বিদেশে গিয়ে একজন বাংলাদেশি সাধারণত এক বছরে ১২ হাজার ডলার বা এর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে পারেন। নগদ বৈদেশিক মুদ্রা কিংবা কার্ড ব্যবহার করে এই পরিমাণ অর্থ খরচের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম কমাতে গত ৩০ আগস্ট এক যৌথ অভিযান শুরু করে। এদিনে অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার, ৩০ হাজার কানাডীয় ডলার ও ৩৮ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত কয়েক জনকে। একইদিন বিশেষ পরিদর্শন শেষে আটটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও ১০ প্রতিষ্ঠানকে ডলার বাণিজ্যে অনিয়মের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্ধারিত দরের চেয়ে তারা বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, এমনকি নিয়মিত তথ্য প্রদানও করেনি।