.অমিতাভ কাঞ্চন ::
শান্তিনিকেতনের সার্থক শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে শুধু রবীন্দ্রনাথেরই অবদান ছিল না। আরো বহু মানুষ ছিলেন যাঁদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা, উৎসাহ এবং পরিশ্রমে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছিল। প্রতিমা দেবী ছিলেন এঁদের মধ্যে অন্যতমা। তাঁর অবদানের কারনেই রবীন্দ্রনৃত্য একটি সফল নৃত্যধারা হয়ে উঠতে পেরেছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন যার ফলে তিনি নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন।
তাঁর আসল কৃতিত্ব শান্তিনিকেতনে মেয়েদের নাচ শেখাবার ব্যবস্থা করা। সেসময়ে বাঙালিদের ভিতরে নাচ শেখাবার খুব একটা ব্যবস্থা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’ এবং ‘মায়ার খেলা’য় যৎসামান্য নাচের অংশ ছিল। তিনি নিজে মঞ্চে উপস্থিত খুব কম হতেন। তাঁর বিয়ের অল্প পরে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’তে তিনি ক্ষীরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এরপর নিজে অভিনয় না করলেও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের তিনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহী। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘চিত্রাঙ্গদা’ বা ‘পরিশোধ’ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার পরিকল্পনা করেন নি। কিন্তু প্রতিমা দেবী যখন নৃত্যনাট্যের খসড়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে যান তখন তিনি এই নতুন শিল্পরূপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। প্রতিমা দেবী কখনও নাচ শেখেননি এবং নিজে নৃত্যশিল্পী ছিলেন না। তিনি বর্ষামঙ্গলের দু-একটি নাচে রূপ দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে ‘পূজারিনী’ কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করাবেন মনস্থ করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘নটীর পূজা’। প্রতিমা দেবী অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করালেন। শ্রীমতীর ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করেছিলেন নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী।
প্রায় চোদ্দ বছর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিমা দেবী রাবীন্দ্রিক গীতিনাট্যের স্থায়ী রূপ তৈরি করলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। এর আগে এসেছিল ‘শাপমোচন’। ‘চিত্রাঙ্গদা’র নাচের বৈশিষ্ট্যগুলি আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল ‘চণ্ডালিকা’তে। প্রতিমা দেবী অন্তরালে থেকে পোশাক পরিচ্ছদ সাজ প্রভৃতির দিকে নজর রাখতেন। মঞ্চ-সজ্জাতেও তিনি শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। তিনি শেষের দিকে মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা ছবি এঁকে রাখতেন। তিনি কলাভবনের শিল্পীদের দিয়ে নাচের ভঙ্গি আঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত নাটকগুলির শালীন সৌন্দর্যের দিকে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। তিনি ‘মায়ার খেলা’ নাটকেরও নতুন রূপ দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ও ‘দালিয়া’, কথা ও কাহিনীর ‘সামান্য ক্ষতি’ প্রভৃতি গল্পগুলিকে ট্যাবলো ধরনের মূকাভিনয় আকারে রূপায়িত করেছিলেন।
প্রতিমা দেবীর নির্দেশনায় শান্তিনিকেতনের নৃত্য কোন বিশেষ প্রকারের নৃত্যশৈলীর আঙ্গিককে গ্রহণ করেনি। মিশ্র তাল ও ভঙ্গির সংমিশ্রনে তিনি বৈচিত্র এনেছিলেন এবং তাকে সার্থক ভাবে সঙ্গীতের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন।
প্রতিমা দেবী ‘কল্পিতাদেবী’ ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকাতে অনেক কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কল্পিতাদেবী ছদ্মনামটি ঠিক করে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো তাঁর কবিতাগুলিকে সংশোধন করে দিতেন। তাঁর গদ্য রচনাগুলিতে লিপিকার বিশিষ্ট ভঙ্গি চোখে পড়ে। তাঁর রচিত স্বপ্নবিলাসী পড়ে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লেখেন মন্দিরার উক্তি।
প্রতিমা দেবী রচিত ‘নির্বাণ’ বইটিতে রবীন্দ্রজীবনের শেষ বছরের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। স্মৃতিচিত্র বইটিতে অবনীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের কথা আছে এছাড়া এতে বাড়ির মেয়েদের কথা এবং উৎসবের কথা। ‘নৃত্য’ বইটিতে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার বিষয়ে লিখেছিলেন। ‘চিত্রলেখা’ তাঁর রচিত কবিতা এবং কথিকার সংকলন।
প্রতিমা দেবী শান্তিনিকেতনে নারীশিক্ষা এবং নারীকল্যাণের দিকেও নজর রাখতেন। তিনি মেয়েদের নিয়ে ‘আলাপিনী সমিতি’ গঠন করেছিলেন। এই সমিতিতে অভিনয় এবং গান হত। তাঁর ব্যবস্থাপনায় আশ্রম থেকে মেয়েরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েদের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, শরীরের যত্ন, হাতের কাজ প্রভৃতি বিষয় শেখাতেন।
# সংগৃহীত ।