সফিক রহমান :::
দেশে চালের সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরো। একক জাত হিসেবে এ মৌসুমে কৃষকরা সবচেয়ে বেশি চাষ করেন ব্রি ধান ২৯। প্রায় তিন দশক ধরে এ জাত চালের জোগানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। সাম্প্রতিক সময়ে এতে ব্লাস্টের সংক্রমণ হওয়ায় অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই এর বিকল্প ভাবছে সরকারও। ব্রি ধান ২৯-এর চেয়েও চিকন ও লম্বা হওয়ায় কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) জাত বিনা ধান ২৫।
বিনা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ বোরো মৌসুমে দেশের ২২টি জেলার ৩৯৬টি উপজেলায় বিনা ধান ২৫-এর চাষাবাদ হয়েছে। উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টরপ্রতি গড় ফলন মিলেছে সাড়ে সাত থেকে সাড়ে আট টন পর্যন্ত। এ জাতের পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১১৬ সেমি। জীবনকাল ১৩৮-১৪৮ দিন। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৫ দশমিক ১ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৬ দশমিক ৬ ভাগ। ২০০৭ সালে জাতটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। মূলত ব্রি ধান ২৯-কে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়েই বিজ্ঞানীরা এ কাজ শুরু করেন। এরপর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সহায়তায় জাপানের অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি থেকে ব্রি ধান ২৯-এর বীজে কার্বন আয়ন রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে মিউট্যান্ট সারি উদ্ভাবন করা হয়। ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত কাজ করার পর কিছু ত্রুটি ছিল। এরপর বিজ্ঞানীদের নতুন একটি দল জাতটির উন্নয়নে কাজ করলে ২০২২ সালে বীজ বোর্ডের মাধ্যমে স্বীকৃতি পায়।
বিনার বিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত ধানের মধ্যে বিনা ধান-২৫ সর্বাধিক লম্বা ও সরু। এটি চিকন চালের আমদানিনির্ভরতা কমাবে। জমিতে পানি জমে থাকলে এবং বৈরী আবহাওয়ায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির কবলে গাছ সাময়িক হেলে পড়লেও জাতটি দু-তিনদিনের মধ্যে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে এবং স্বাভাবিক ফলন দেয়। বিনা ধান ২৫-এর জীবনকাল মাতৃজাত ব্রি ধান ২৯-এর চেয়ে ১৫-২০ দিন কম। ফলে বাংলাদেশের শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করে সহজেই এক জমিতে বছরে তিন-চারটি ফসল চাষ করা যাবে।
জানতে চাইলে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু ব্রি ধান ২৯-কে এর চেয়ে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাশাপাশি জীবনকালও কমিয়ে আনার লক্ষ্য নেয়া হয়েছিল। বিনা ২৫-এ দেখা যায়, এ জাতের চাল ব্রি ২৯-এর চেয়ে আরো চিকন ও লম্বা। জীবনকালও দুই সপ্তাহ কম। ফলনও বেশি। এটা ব্রি ধান ২৯-এর বিকল্পই শুধু নয়, বরং বাসমতির চাহিদাও পূরণ করবে।’
মাগুরার সদর উপজেলার মাঘী গ্রামের কৃষক আলম মোল্লা এ বছর ৫০ শতক জমিতে বিনা ধান ২৫ রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘কাটার অপেক্ষায় আছি। দেখে ফলন অনেক ভালো মনে হচ্ছে। আগে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ করতাম। তখন যা খরচ হতো সে রকমই খরচ হয়েছে। তবে সার ও কীটনাশক আগের চেয়ে কিছুটা বেশি লেগেছে।’ একই গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘ধান ভালো হয়েছে। তবে কিছু ধান চিটা হয়েছে। তাছাড়া প্রথম দিকে একটু বেশি সার দিতে হয়েছে। কিন্তু পরে অল্প দিলেই হয়ে যাচ্ছে। পানিও কম লেগেছে। সময় লেগেছে কম। যদিও কীটনাশক বেশি দিতে হয় এ ধানে। আগের জাতগুলোয় দুইবার কীটনাশক দিলে হয়ে যেত। এখন নতুন যে জাতগুলো আসছে সেগুলোয় চারবার দিতে হয়।’
চিটার বিষয়ে বিনার মহাপরিচালক বলেন, ‘ধানের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ চিটা বা সমপরিমাণ ঝরে যাওয়া কোনো সমস্যা নয়। কৃষকরা দেরিতে রোপণ করার কারণে মাগুরায় কিছুটা চিটা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য যে স্থানে আগে রোপণ করা হয়েছিল সেখানে কোনো চিটা হয়নি। বোরো মৌসুমে জীবনকাল কমিয়ে যেন আরো আগে কর্তন করা যায় সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এ জাত আরো এক মাস আগে কর্তন করার কথা।’
নতুন জাতটির উদ্ভাবক ও বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাকিনা খানম বলেন, ‘প্রথমে আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞানীরা জাতটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু উনারা রিলিজ দিতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে। আমি পিউর লাইন সিলেক্ট করি। এরপর দু-তিন বছর যাচাই-বাছাই শেষে জাতের জন্য আবেদন করি। নতুন জাতের ক্ষেত্রে আগের জাতের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি ফলন পেতে হয়। কিন্তু আমরা আটটি স্থানে ১৫-২০ শতাংশ বেশি ফলন পাই।’ এ বিজ্ঞানী আরো বলেন, ‘মোটা ধান মিলাররা চিকন করে। কিন্তু এ জাত এতই চিকন যে আর চিকন করার সুযোগ নেই। এতে সব ধরনের গুণাগুণ ঠিক থাকবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, ‘হেক্টরপ্রতি আট টনের মতো ফলন পাওয়া যায় বিনা ২৫ জাতের ধানে। রোগবালাই অনেক কম। রাসায়নিক সারের পরিমাণও কম লাগে। জাতটি ইনব্রিড। ফলে প্রতি বছর আর বীজ কিনতে হবে না। কৃষকরা চাইলে নিজেই বীজ করতে পারবেন। আগামী বছর থেকে এ জাতকে প্রণোদনা দেয়ার মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা হবে।’