নিজস্ব প্রতিবেদক ::
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সহযোগিতায় ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ধনী দেশগুলোর আরো এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ফান্ড (অর্থায়ন) দিতে হবে। গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, বহু দেশ এখনো স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে আছে। তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যে সমস্ত এলাকা এখনো উন্নত না বা স্বাস্থ্যের দিকে খুব বেশি এগোতে পারেনি; একটা ভালো ফান্ড তৈরি করে তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে সহযোগিতা করা উচিত। কারণ স্বাস্থ্যটাই হচ্ছে সকল সুখের মূল।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে একটা পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টাকে আরো গুরুত্ব দেয়া দরকার এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটা প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ফেলা উচিত।
তিনি বলেন, তাহলে কোন দেশের জন্য কোনটা বেশি প্রয়োজন, সেটা সুনির্দিষ্ট করা এবং সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এটা সকলকে একসঙ্গে করতে হবে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিত্সাসেবা ও ৩০ ধরনের ওষুধ প্রদান, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে ইনসুলিন প্রদান, নতুন নার্স ও চিকিত্সক নিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা-সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ, মায়েদের মাতৃত্বকালীন ও প্রসবকালীন সেবা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিভিন্ন জেলা-উপজেলা হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো, উন্নত সরঞ্জাম ব্যবহার করে চিকিত্সাসেবার মান বৃদ্ধি, বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় চিকিত্সাসেবা পৌঁছে দিতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সব ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যসেবা শুধু চিকিত্সা বা ওষুধ খাওয়ানো না, সেই সঙ্গে তার খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সার্বিক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সফলতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না, ছোট্ট একটা ভূখণ্ড, বিশাল জনগোষ্ঠী, সামাল দেয়া খুবই কষ্ট, তার পরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং আমরা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, শুধু আমাদের স্বাস্থ্যসেবাই না, সব কাজ আমরা একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে যেন পৌঁছে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে থাকি।
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট-বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকবার বাজেটে বিরাট অংশ আমরা দিই। জিডিপিতে ২ শতাংশ ধরলেও টাকার অংকে আমরা অনেক বেশি সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বেসরকারিভাবে স্বাস্থ্য খাতের বিকাশে মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানিতে ট্যাক্স কমানো এবং শিশুদের চিকিত্সা সরঞ্জাম আমদানিতে কর মওকুফের বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি।
দারিদ্র্য বিমোচন করতে সরকারের নানা পদক্ষেপ ও সফলতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে আমরা অনেক সফল। ২০০৬ সালে ৪১ শতাংশ দারিদ্র্য ছিল। এটি আমরা ১৮ দশমিক ৭ ভাগে নামিয়ে এনেছি। আমাদের চরম দারিদ্র্য যেটা ছিল ২৫ শতাংশের ওপরে, সেটা কিন্তু ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে, এটাও থাকবে না। আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সকলের জন্য এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে কোনো মানুষই আর দরিদ্র থাকবে না।
সেবা কার্যক্রম তদারক করতে জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বাড়িয়ে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা হবে।
ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচও, বিশ্বব্যাংক, সূচনা ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন এবং লন্ডনের চ্যাথাম হাউজের মতো বেশ কয়েকটি জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে চ্যাথাম হাউজ কমিশন অন ইউনিভার্সাল হেলথের কো-চেয়ার হেলেন ক্লার্ক। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের সদস্য, যুবনেতারা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
হেলেন ক্লার্ক তার বক্তৃতায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, বিস্তৃত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ক্রমবর্ধমান সরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে। একটি স্বাস্থ্যবান জনগোষ্ঠী ও একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এ বিনিয়োগ সাশ্রয়ী ও ন্যায়সংগত।
স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের নেটওয়ার্কের জন্য, সব শিশুকে টিকাদানের আওতায় আনার জন্য এবং কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা ও টিকাদানে সাম্প্রতিক সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ইউএইচসির একজন প্রবক্তা এবং আমরা তার নেতৃত্বে ইউএইচসি অর্জন করতে সক্ষম হব।
অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি ও বিশেষজ্ঞরা তাদের কাছে করা প্রশ্নের উত্তর দেন। অংশটি পরিচালনা করেন মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম-বিষয়ক ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালকের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস, বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ড. বর্ধন জং রানা ও বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট।
অনুষ্ঠানে শেলডন ইয়েট বলেন, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশু ও পরিবারগুলোসহ সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়ায় ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সবাইকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা গেলে তা দেশগুলোকে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেয়। আর এ সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ।
বাংলাদেশ এসডিজি-৩ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একই দিন রাজধানীর একটি হোটেলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও চ্যাথাম হাউজ কমিশনের কো-চেয়ার হেলেন ক্লার্ক শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে অংশ নেন। এ সময় কভিড মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকটের কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জাতিসংঘের এসডিজি-৩সহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, সরকার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১১-৩০ বাস্তবায়নে কাজ করছে।
সাক্ষাত্কালে প্রধানমন্ত্রী ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের আরো উন্নয়নের জন্য তার সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে হেলেন ক্লার্ককে অবহিত করেন। তিনি ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন, এ খাত থেকে এখন ১০০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, সরকার দেশে গবেষণা পরিচালনা, কভিড-১৯ ও অন্যান্য ভ্যাকসিন উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরি সহায়তায় গোপালগঞ্জে একটি ভ্যাকসিন উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে।
জবাবে নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কভিড-১৯ ভ্যাকসিনসহ বিশেষ ওষুধ রফতানিকারক হতে পারে।
আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (ইউএনজিএ) তার আসন্ন অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা জানান, তিনি নিউইয়র্কে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজসহ অন্যান্য জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য অধীর অপেক্ষা করছেন।
এ সময় হেলেন ক্লার্ক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বৈঠককালে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালকের মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম-বিষয়ক উপদেষ্টা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও স্বাস্থ্য সচিব ডা. মো. আনোয়ার হাওলাদার উপস্থিত ছিলেন।