দু‌টো ডাল ভা‌তের সংস্থান না রে‌খে কা‌রো সা‌হি‌ত্যিক হওয়া ঠিক নয় : মানিক ব‌ন্দোপাধায় – দৈনিক মুক্ত বাংলা
ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৫ মে ২০২৩
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি-ব্যবসা
  3. আইন ও আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আরও
  6. ইসলাম ও ধর্ম
  7. কোভিট-১৯
  8. ক্যারিয়ার
  9. খেলা
  10. জেলার খবর
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. বিনোদন
  13. মি‌ডিয়া
  14. মু‌ক্তিযুদ্ধ
  15. যোগা‌যোগ

দু‌টো ডাল ভা‌তের সংস্থান না রে‌খে কা‌রো সা‌হি‌ত্যিক হওয়া ঠিক নয় : মানিক ব‌ন্দোপাধায়

সম্পাদক
মে ২৫, ২০২৩ ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

অ‌মিতাভ কাঞ্চন ::

ঘুটঘুটে কালো ছেলেটি চার ভাইবোনের পর জন্ম নিয়েছিল গায়ের ওই রং দেখে আঁতুড় ঘরেই নাম দেওয়া হল কালোমানিক,ঠিকুজিতে নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র, পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার যদিও প্রথম দুই নামে তাকে কেউ ডাকেন নি৷ গণিত ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়,কিন্তু সাহিত্যপাঠে কখনও ছেদ পড়েনি৷
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য চর্চায় রেগে দাদা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলে তাকে চিঠির উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব।
রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’ সাহিত্যজীবনের শুরু থেকে আর্থিক অসচ্ছলতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিত্যসঙ্গী,একসময়ে কখনও-কখনও শুধুমাত্র মুড়ি খেয়েই তাঁর দিন কেটেছে,নিজেকে বর্ণনা করেছেন ‘কলম পেষা মজুর’বলে ৷

সাহিত্যজীবনের শুরু থেকে আর্থিক অসচ্ছলতা,চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কত বড় মনের মানুষ ছিলেন সেই কাহিনী অন্তত আমাদের অনেকের অজানা না হলেও বারবার উল্লেখ করা যায়৷ ১৯৩৪-৩৫সাল ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকার সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের পদের জন্য আবেদন করলেন,সঙ্গে লিখেদিলেন ওই একই চিঠিতে আরেকজন প্রার্থী পরিমল গোস্বামী যদি আগেই এই পদের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিজের আবেদনপত্র প্রত্যাহার করছেন কারণ ‘আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি’৷ এবং ‘পরিমল গোস্বামী মহাশয়ের সহিত আমি প্রতিযোগিতা করিতে ইচ্ছুক নহি’৷ এই হলেন মানুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল পরিচয়, ‘বঙ্গশ্রী’পত্রিকার সহকারী সম্পাদক তিনি হয়েছিলেন যদিও সে ঘটনা১৯৩৭সালের৷

যে মানিক একদিন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, সেই মানিকই অধ্যাপক বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে তাদের বাড়িতে দুপুরে খেয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’

দারিদ্র যে কী ভয়ংকর ছিল তাদের সংসারে জানা যায় মানিকের ডায়েরির একটি পৃষ্ঠায়,স্ত্রী ডলি অর্থাৎ কমলা এক মৃত সন্তানপ্রসব করেছেন, আর মানিক ডায়েরিতে লিখছেন, ‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’

কিশোর মানিক টাঙ্গাইলে নদীর ধারে নোঙর করা নৌকায় মাঝিমল্লাদের সঙ্গে এখানে-ওখানে হঠাৎ চলে যেতেন,দু’তিনদিন তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যেত না৷ শহরের গাড়োয়ানদের সঙ্গে গল্পে রাত হয়ে গেলে গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে নিতেন৷যমুনার চরে যেসব ছোট নৌকা টাঙ্গাইল বাজারে দুধ নিয়ে আসত সেগুলি দখল করে ঘোর বর্ষায় বন্ধুদের সঙ্গে নদীতে বাইচ খেলতেন৷

ষোলো বছরে মায়ের অকাল মৃত্যু হয়,গভীরভাবে মানিকের জীবন কে প্রভাবিত করে এবং ওই বয়স থেকে তিনি লিখতে শুরু করেন তাঁর প্রাথমিক কবিতাগুলি৷ প্রথাগত স্কুল শিক্ষা শুরু কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে,তবে ছোটবেলা থেকে যেমন ছিলেন দুরন্ত আর টাঙ্গাইলে থাকার সময় বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটাতেন,কিন্তু মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি বাড়ে,বাড়িতে আসত নানা পত্রপত্রিকা ফলে সাহিত্য পাঠের অভ্যাস স্কুল জীবন থেকে গড়ে ওঠে৷

নীরদাসুন্দরীর মৃত্যুর পরে ছন্নছাড়া পরিবারটিকে নিয়ে বাবা ডাক্তার ছেলের কাছে কাঁথিতে চলে এলেন, মডেল হাইস্কুলে মানিক ভর্তি হল,তবে কালাজ্বর হল,অসুস্থ হলে তাঁর স্বাস্থ উদ্ধারের জন্য মেদিনীপুরে বড়দি শিশিরকুমারী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো হয়৷ মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক গণিতে লেটার সহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন,এরপর বাঁকুড়ার ওয়েলেসলি মিশন কলেজে ভর্তি হয়ে হস্টেলে থেকে আই.এসসি পড়েন,গণিত ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়,কিন্তু সাহিত্যপাঠে কখনও ছেদ পড়েনি৷আই,এসসি উত্তীর্ণ হলেন প্রথম বিভাগে,বাবার আগ্রহে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অঙ্কশাস্ত্রে বি.এসসি অনার্সে ভর্তি হলেন৷তারপরের ইতিহাস অজানা নেই সাহিত্যের রসিক পাঠকদের ‘পদ্মানদীর মাঝি’,’পুতুলনাচের ইতিকথা’র স্রষ্টার জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে৷
প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে বলেছিলেন নতুন লেখক হলেও লেখা যদি ভালো হয় এমন কি যদি চলনসইও হয় তাহলে পত্রিকায় ছাপানো সম্ভব,নিজের লেখা দিয়েই নিজের কথা প্রমানের জেদ৷ গল্প রচনা করতে তিনি বিষয় নির্বাচন করেছিলেন প্রেম,আর চেনা দম্পত্তির সম্পর্ককে৷ লিখলেন ‘অতসীমামী’ছদ্মনামে গল্পটি প্রকাশের কথা ভেবেছিলেন তবে শেষে নিজের ডাকনাম ব্যবহার করেন,তারপর বিচিত্রা পত্রিকার অফিসে লেখাটি দিয়ে আসেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের হাতে৷বিচিত্রার পৌষ (১৩৫৫) সংখ্যায় প্রকাশিত হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘অতসীমামী’৷পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে সংখ্যাটি হাতে করে মানিকের বাড়ি পৌঁছে দিলেন,সঙ্গে পারিশ্রমিক বাবদ কুড়ি টাকা৷

ছোটবেলায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কান্না আসত না,স্বজনরা বুঝতে পারতেন না তিনি কাঁদছেন নাকি তিনি সুর করে গাইছেন৷বঁটিতে পেট অনেকটা কেটে গিয়েছে,রক্তক্ষরণ হচ্ছে অবিরাম,সেলাই দেওয়া হল শিশু মানিক একটুও কাঁদেনি একথা শুধু তিনি নিজে নন বড় বৌদি ও সেজদা বলেছেন৷কুস্তি শিখতেন,সেখানেও পালোয়ানদের কাছে উচ্ছ্বসিত বাহবা পেয়েছেন৷একবার ছোটভাই নালু (সুবোধ)কে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে একক মারামারিতে তাদের পরাস্ত করেন,পাড়ায় আগুন লাগলে তিনি এগিয়ে আসতেন ৷
লেখক পত্নী, স্বামী সম্পর্কে বলেছেন,নিজের লেখা সম্পর্কে গভীর আস্থা ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের,প্রতিভাবান মানুষের স্ত্রী হয়ে বিড়ম্বনা ভোগ করেন নি কিন্তু মানিকবাবুর বেহিসাবি বাজার করা,কাউকে নিমন্ত্রণ করে তাঁকে অসময়ে জানানো,আর মদ্যপানে দাম্পত্যবিরোধ ঘটেছে৷ স্ত্রী কমলা আরও বলেছেন লেখার বিষয় নিয়ে দু’জনের মধ্যে কোনও আলোচনা হত না,তাঁর শুধু একটা কাজ ছিল সেইসময় স্বামীর লেখার ফাঁকে ফ্লাস্কে চায়ের জোগান অব্যাহত রাখা৷ যখন লেখা আসছে না তখন হয়ে যেতেন অন্যমনস্ক,জ্যৈৎস্নারাতে বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতেন,কখনও আড়বাঁশি বাজানো৷

বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়,নিজের সাহিত্যচর্চাকে অবিরত তাঁর জীবনচর্যার সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করেছেন৷অনেকে বলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের লেখা হোক,অথবা জীবন সর্বত্র ছিলেন বেহিসেবি,আগোছালো!তবে এই কথাগুলি আক্ষরিক অর্থে সঠিক কি না সেই বিষয় খতিয়ে দেখার প্রয়োজন৷ছোটবেলায় তাঁর লেখক হবার সাধ ছিল,লেখক হতে গেলে যে মানসিক পরিণতি দরকার সেইজন্য ত্রিশ বছর থেকে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করবেন পরিকল্পনা তেমন ছিল,তবে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে ১৯২৮ সালে মাত্র কুড়ি বছরে তাঁর জীবনের প্রথম গল্প লিখেছিলেন,কলেজের পাঠ অসমাপ্ত রেখে সাহিত্যচর্চায় পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন,এই সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না,তবে যে সমাজ থেকে তিনি এসেছিলেন সব বিবেচণা করেই নিজের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত তিনি বোধহয় অনিবার্য মনে করেছিলেন৷নিজেকে বর্ণনা করেছেন ‘কলম পেষা মজুর’বলে যার একটি মাত্র সম্পদ ছিল সৃজনী শ্রম৷কিন্তু সেই শ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক সর্বদা পেয়েছেন কিনা প্রশ্ন থাকলো,না হলে কেউ বন্ধুর বাড়িতে খেয়ে বলতে পারেন ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’প্রবাদপ্রতিম কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিবসে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য৷

সংকলনে – Arunava Sen
গ্রন্থঋণ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার- অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরি ও চিঠিপত্র, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত,কিশোর রচনা সমগ্র,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়- (সম্পা- সৈয়দ আজিজুল হক),
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজজিজ্ঞাসা,নিতাই বসু,আনন্দবাজার পত্রিকা৷

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।