আরিফ হোসেন নিশির ::
আমেরিকার স্যাংশন হুমকি আর আন্তঃজাতিক মহলের বাধা বিরোধী জোটের প্রতিহতের আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। ভাবাহচ্ছিল সরকারের এবার পতন অনিবার্য ! এতসব হুমকির মধ্যেও দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনী বৈতরনী পার করেছে শাসকদল আওয়ামী লীগ। যারা গনতন্ত্রের জন্য ক্রন্দনরত, জনগনকে মৌলিক দাবী আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ ! সেই বিএনপি ও সমমনা জোট বা দলের অনেক নেতাই জানেন না নির্বাচনী বৈতরনী পার হবার জন্য কিংস পার্টি সৃষ্টির খেলা নতুন নয় ! খোদ মেজর জিয়ায় করেছিলেন প্রথম, সেদিন তিনি আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ ( মিজান) দুটি নামে ব্রাকেট বন্দী করে দিয়েছিলেন। এক আওয়ামী লীগ সম্ভবত মালেক গ্রুপ পেয়েছিলেন নৌকা প্রতীক আর মিজানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ মই মার্কা।
তাহলে আজকে বিএনপি আবার কিংস পার্টি সৃষ্টির জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলেন কেন ? বোধগম্য নয় ! কারণ এ খেলার উদ্ভাবক ও রেফারী তো ছিলেন তারাই।
আবার বিএনপি নেতারা কেউ কেউ বলেন, সরকারের দমন পীড়ন আর পুলিশের গুলির ভয়ে তানা মাঠে নামতে পারেন না। জনগনের মৌলিক দাবী গ্যাস, বিদ্যুত, তেল, চাল, ডাল, ভৌজ্য তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদের মতো আন্দোলন করতে তারা পারে না। এখন প্রশ্ন তারো যখন সরকারের ছিলেন তারা কি বিরোধীদলকে আদর করতেন ?
আন্দোলন সংগ্রামে কোন বাধা দিতেন না ?
সে দিন যারা মাঠে ছিলেন তারা জানেন ক’জন আওয়ামী লীগ নেতা প্রাণ হারিয়েছিলেন । মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, সাহারা খাতুন, সাবের হোসেন চৌধুরীদের মতো রাজনীতিবিদদেরকেউ রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত যখম করা হয়েছিল।
২০০৪ সালের একুশে আগষ্ট গ্রেনেড হামলা করে খোদ দলীয় সাভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল নেতাদের উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল ! সেদিন আল্লাহর অশেষ কৃপায় জননেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি রক্ষা পেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন প্রায় সকল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা। সাংবাদিকদের মধ্যে আমি নিজে আহত হয়েছিলাম সাথে এটিএন বাংলার সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধু রিয়াজুল ইসলাম ওরফে সৈয়দ রিয়াজ, ভিডিও জার্নালিষ্ট জাকির হোসেন মিন্টু, চ্যানেল আই এর সাংবাদিক আশরাফুল আলম খোকন, প্রধান মন্ত্রীর সাবেক ফটোগ্রাফার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ অনেকেই।
এতসব পুলিশী ও দৃস্কৃতিকারিদের হামলার মধ্যেও আন্দোলন সংগ্রাম থামাতে পারেনি সরকার। তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী আদায় করেছিল আওয়ামী লীগ।
উপরের তথ্যে দেখা যায় যে, আসলে সরকারি দল বিরোধী দলের আন্দোলন সংগ্রামকে বাধাই দেয় আদর করে না। এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ দল নিয়ে টিকে থাকতে হলে দলকে বাচাতে হবে। বাচতে হলে বাচাতে হবে এই স্লোগান বাস্তবায়ণ করতে হবে। না হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের থিউরি সংকটের মতো রাজনৈতিক দল গুলো মুসলিম লীগ কিংবা ন্যাপ হয়ে যাবে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও এখেলা অস্তিত্ব সংকটে কংগ্রেসের মতো ঐতিহ্যমন্ডিত দল। বাংলাদেশে তো মুসলিম লীগ , ন্যাপ এর মতো দল গুলো তো জীবন্ত উদাহরণ।
দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটেনি। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন বসতে যাচ্ছে আগামী ৩০ জানুয়ারি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ডামাডোল বাজতে শুরু করেছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে সাধারণ নির্বাচন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন, ৯টি পৌরসভা, কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে ২৩৩টি সাধারণ ও উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এটিই বোধ হয় বিএনপির জন্য সহজ সমীকরণ হতে পারে। প্রতিহত, প্রতিরোধ কিংবা বর্জন করতে গিয়ে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি কিছু অর্জন করতে পারেনি, বরং হারিয়েছে অনেক কিছু। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে এমনটি বলছেন, দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। এই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা থেকে মুক্তির পথ হতে পারে আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি নিশ্চয় এটুকু বুঝতে পারে যে জনসম্পৃক্তি বাড়ানোর জন্য নির্বাচন একটি বড় সুযোগ। সেই সুযোগটি যখন সামনে চলে আসে, তখন তা গ্রহণ করার তো কোনো বিকল্প নেই। সুযোগ তো আর বারবার আসবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করায় বিএনপি নেতাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কাজেই তৃণমূলের নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নেবেন। আর তেমনটি ঘটলে দলীয় শৃঙ্খলা কি থাকবে?
কেবল বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা আর বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে বিএনপি রাজনীতির মূল ট্র্যাক থেকে দূরে সরে গেছে। এখন তাকে ট্র্যাকে ফিরতে হবে। সে জন্য তার দরকার একটি নিরাপদ পথ, যে পথ দিয়ে নিরাপদে রাজনীতির রেসে আবার ফিরে আসা যায়। সেই পথটি হতে পারে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। ৪৫ বছর বয়সী বিএনপি নেতৃত্ব রাজনৈতিকভাবে কতটা সাবালক কিংবা দূরদর্শী হয়ে উঠতে পেরেছে, সেটা প্রমাণ করার সময় চলে এসেছে। স্থানীয় নির্বাচনের এই পথ দিয়ে রাজনীতির রেসে আবার ফিরে আসার সুযোগ না নিলে সেটাই হবে বিএনপির আরেকটা ঐতিহাসিক ভুল। রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক।
বিএনপি অর্থাৎ ইংরেজিতে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি, বাংলায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। রাজনীতি থেকে দূরে সরে যেতে যেতে বিএনপি হয়তো একদিন জনসমর্থনহীন একটি সংগঠনে পরিণত হবে। তখন হয়তো দলটির সাইনবোর্ড থাকবে।
মুসলিম লীগ কিংবা ন্যাপ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ভুলের খেশারত নিজেদেরকেই দিতে হবে।
লেখক : টেলিভিশন সাংবাদিক ও দৈনিক মুক্ত বাংলা সম্পাদক ।