রবি ঠাকুরের ডা‌য়েরী – দৈনিক মুক্ত বাংলা
ঢাকাশনিবার , ৪ মে ২০২৪
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি-ব্যবসা
  3. আইন ও আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আরও
  6. ইসলাম ও ধর্ম
  7. কোভিট-১৯
  8. ক্যারিয়ার
  9. খেলা
  10. জেলার খবর
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. বিনোদন
  13. মি‌ডিয়া
  14. মু‌ক্তিযুদ্ধ
  15. যোগা‌যোগ
 
আজকের সর্বশেষ সবখবর

রবি ঠাকুরের ডা‌য়েরী

বার্তা কক্ষ
মে ৪, ২০২৪ ১১:৫৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

অ‌মিতাভ কাঞ্চন ::

কাদম্বরীদেবী মারা যাওয়ার পর স্বজনদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তাঁকে ভালোবাসি’…

১৯০৮ সালের মে মাস! এক ঊনষাট বছরের পুরুষ ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতায় আনমনে লিখে রাখছেন কিছু শব্দের কোলাজ—

‘আজ আমার জন্মদিন— ৫৯ বৎসরে পদার্পণ করলুম— মেজো বৌঠানের কাছে ধুতি-চাদর-রুমাল ও পাঞ্জাবী পেলাম— মেজদাদা একটা বই দিয়েছেন— বৈকালে কোলদের নাচ হল— পানিবাবু— নরেন ডাক্তার এসেছিলেন—’

জন্মদিনে এইটুকু পাওয়া? এইটুকু মাত্র স্বীকৃতি হয়তো প্রাপ্য ছিল না মানুষটার। ওই ডায়েরির পাতা থেকে জানা যায়, ডায়েরি লেখকের লেখা ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ নাটকটিও নাকি অভিনয় করা হয়েছিল সেদিন। অনেকেই এইবার অনুমান করে নিয়েছেন, কার কথা বলছি। এই উদাসী শব্দগুলি যিনি লিখেছিলেন, তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অত্যন্ত প্রতিভাবান এক সদস্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদা সুন্দরী দেবীর ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ১৮৪৯ সালের ৪ মে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়। বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। রূপে, গুণে, উৎসাহে, উদ্দীপনায় সেই আমলের প্রতিভাবান তরুণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একদিকে নাটক লিখছেন, অন্যদিকে অনুবাদ করছেন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায়। ‘সরোজিনী’, ‘অলীকবাবু’— এই নাটক দুটি অত্যন্ত সাড়া ফেলেছিল তখনকার নাট্যমহলে। বাংলা নাট্যসাহিত্যে অদ্ভুতনাট্যের ধারা তিনিই নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বহুভাষাবিদ ছিলেন। গান লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, জমিদারি পরিচালনা করেছেন, স্বদেশি স্টিমারের প্রচলন করেছেন। ঠাকুরবাড়ির হিন্দুমেলা, স্বদেশী সভা, ভারতী পত্রিকা, তাঁতের কাপড় কল প্রতিষ্ঠা, শিকার ও বন্দুক চালনা শেখানো, সর্বজনীন পোশাকের প্রচলন— সব তাঁর উদ্যোগে সম্ভব হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভার সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সেতার, পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম বাজাতেন অনায়াসে। বীণাবাদিনী নামে একটি সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখে রোটেনস্টাইন মুগ্ধ হয়েছিলেন। বর্তমানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা অনেক ছবি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।লালন ফকিরের একমাত্র ছবিটি তাঁরই আঁকা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নীলচাষ করে অর্থ উপার্জন করেছিলেন একসময়। খুলনা ও বরিশালের ভিতর দিয়ে স্টিমার চলার প্রয়োজনে স্টিমারের শেল কিনেছিলেন তিনি। পরে তা ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত করে জাহাজ চালু করেন— সরোজিনী নামে। তারপর ফ্লোটিলা নামের ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ভাগ্যের পরিহাসে এই জাহাজের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিভাবান এই যুবক নিজের অজান্তে আরো একটি কাজ করে গিয়েছেন। একটি কিশোর ছেলেকে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে মুগ্ধ ও আবিষ্ট করে গিয়েছেন। সেই কিশোর ছেলেটি একদিন বিশ্বকবি হবেন। জগৎ জোড়া তাঁর নাম! সেদিনের কিশোর রবি তথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষে পৌঁছেও জ্যোতিদাদার কথা বলবেন বারবার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বালককেও শ্রদ্ধা করতে জানতেন। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল নিজের মতো করে। একটা সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরম নির্ভরতার জায়গা। একথা কোনোদিন অস্বীকার করেননি রবীন্দ্রনাথ।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী ছিলেন ঠাকুরবাড়ির কর্মচারী শ্যামলালের মেয়ে। সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর তখন অনেক আশা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নিয়ে। কর্মচারীর মেয়ে কাদম্বরীকে কোনোদিনই সুনজরে দেখতে পারেননি তাঁরা। নিজেদের অসন্তোষও তাঁরা যথেষ্ট প্রকাশ করেছিলেন। অথচ এই কাদম্বরীকে কেন্দ্র করেই জোড়াসাঁকোর তেতলার ছাদে জন্ম নিল ‘নন্দন কানন’! একসময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রেরণায় কাদম্বরী ঘোড়ায় চড়ে তাঁর সঙ্গে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন। কাদম্বরীকে পেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল সেই সময়। ঘরোয়া পরিবেশে শুরু হল সাহিত্যচর্চা। কখনও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সস্ত্রীক চলে যেতেন চন্দননগরের গঙ্গাতীরে, মোরান সাহেবের বাগান বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ থাকতেন তাঁর প্রিয় দুটি মানুষের সঙ্গে। খোলা আকাশ, তিনটি উদার শিল্পী মন, তরুণ বয়স, অপার মুগ্ধতা —জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন তখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ‘জীবনস্মৃতি’তে স্মৃতিচারণা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এই পূর্ণ বিকশিত পদ্মফুলের মতো মুহূর্তগুলির। ঠিক যেন ল রূপকথা! কিন্তু, জীবন বড়ো নিষ্ঠুর। তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনটা রূপকথা হতে গিয়েও হল না। কাদম্বরীর একাকিত্ব, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদাসীনতা, ভাগ্য বিপর্যয়, সন্তানহীনতা, জীবনের ব্যস্ততা— একে একে দুর্ভাগ্যের দূত হয়ে এল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো অমন নাট্যকার যেন গিরিশ ঘোষকে নিজের আসন ছেড়ে দিলেন। এই প্রসঙ্গে অমৃতলাল বসুকে বলেছিলেন, ‘নাট্যজগতে গিরিশচন্দ্র প্রবেশ করিয়াছেন, আমার নাটক রচনার আর প্রয়োজন নাই।’ ব্যবসায় ভরাডুবি আর স্ত্রীর আত্মহত্যা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। কাদম্বরী যখন মারা যান, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স তখন পঁয়ত্রিশ। অথচ সারাজীবন অন্য কোনো নারী আসেনি তাঁর জীবনে। স্বজনদের প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছিলেন, ‘তাঁকে ভালোবাসি।’ শুধুই অনুশোচনা? নাকি পথ ভুলে যাওয়া ভালোবাসার স্বীকৃতি? একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসনই নিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কাজ পাগল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনের শেষ সময়টা কাটে রাঁচিতে, মোরাদাবাদ পাহাড়ে, শান্তিধামে। বিলাসী এই মানুষটির গৃহসজ্জা বলতে ছিল একটিমাত্র ছবি— নিজের হাতে আঁকা কাদম্বরী দেবীর পেনসিল স্কেচ। এই নির্বান্ধব পুরীতে জীবনের প্রিয় মানুষের ছবি বলে দেয় অনেক না বলা কথা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বেদনার ইতিহাস বড়ো কম নয়! প্রিয় রবীন্দ্রনাথের চোখে তিনি ছিলেন আদর্শস্থানীয়। অথচ কাদম্বরীর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের মনে এই আদর্শের উচ্চতা থেকে তাঁকে যে নামিয়ে দিয়েছিল— একথা বুঝতেন তিনি। এই বেদনা বুকে নিয়েই তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী কাদম্বরীর মৃত্যুর পর ‘সাধের আসন’ কাব্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে রীতিমত আক্রমণ করেছিলেন কবিতার ভাষায়। রবীন্দ্রনাথও কি দায়ী করেননি তাঁকে? আর তিনি নিজে? হয়তো জীবনের এই পরিহাস তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল। জীবন তাঁকে যা যা দিয়েছে, সব কেড়ে নিয়েছে এক এক করে। সত্যেন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনীর পরিবারের অংশ হয়ে, নিজের হঠাৎ থেমে যাওয়া জীবনের গতি ছাড়াও নিজের প্রকাশহীন শিল্পচর্চার গল্পই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনের ট্র্যাজেডি।

১৯০৮ সালে লেখা জোতিরিন্দ্রনাথের ডায়েরি, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনী থেকে তাঁর জীবনের ঘটনা জানা যায়। কিন্তু তাঁর ব্যথার কাহিনি কেউ লেখেনি। সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথের প্রতি জীবনের শেষবেলাকার সবটুকু স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। হয়তো ঠাকুরবাড়ির এই বালকটিকে ফেলে আসা জীবনের অপূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে স্বস্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির এই প্রতিভা পূর্ণ সিদ্ধি পেল না এক জীবনে। এক সময়ের উজ্জ্বল বহ্নিশিখার দীপ নিভে যাওয়ার গল্পটি সত্যি বড়ো বেদনার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেন এক অভিশপ্ত গন্ধর্ব। ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ তাঁর শাপমুক্তি ঘটেছিল।

সহায়ক গ্রন্থ :-

১. ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব।
২. ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল, চিত্রা দেব।
৩. কবিমানসী, প্রথম খণ্ড, জগদীশ ভট্টাচার্য।
৪. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

(লেখা:- মহুয়া দাশগুপ্ত)

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।