যেদিন দেশ ভাগ হ‌লো – দৈনিক মুক্ত বাংলা
ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৯ মে ২০২৪
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি-ব্যবসা
  3. আইন ও আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আরও
  6. ইসলাম ও ধর্ম
  7. কোভিট-১৯
  8. ক্যারিয়ার
  9. খেলা
  10. জেলার খবর
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. বিনোদন
  13. মি‌ডিয়া
  14. মু‌ক্তিযুদ্ধ
  15. যোগা‌যোগ
 
আজকের সর্বশেষ সবখবর

যেদিন দেশ ভাগ হ‌লো

বার্তা কক্ষ
মে ৯, ২০২৪ ৫:১৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

অ‌মিতাভ কাঞ্চন ::

” “এক পা কেবল পাড়ে আছে এক পা দিছি নায়।”
সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। উত্তাপ নিঃশেষ হয়ে এসেছে।সন্ধ্যার কালোছায়া আষ্টেপৃষ্টে ক্রমশই আমাকে গ্রাস করছে। অজানা আতঙ্কে আমি সদা ম্রিয়মাণ। এ জীবনে নেই কোন মুখরতা, নেই কোন আবেগ,নেই কোন অভিযোগ, আছে শুধু মরীচিকার মলিনতা,মিথ্যা আশা আর সীমাহীন ধূসরতা।ভারবাহী বৃদ্ধ পশুর মত জীবনটা কোন উপায়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলছি। আপন জনের কাছে অবাঞ্ছিত,লতাপাতাহীন শুষ্ক বৃক্ষ ছায়া নেই তাই পথিক বসে না ফল নেই তাই পাখী বসে না।বৃষ্টি থেমে গেলে ছাতা বোঝা মনে হয়।শুনতে ভালো লাগে “Old is gold” কিন্তু বাস্তবে “No body salutes the setting sun.
আজকের মনদিয়ে, আজকের চোখ দিয়ে চুয়াত্তর বছর আগেকার দৃশ্যপট সঠিক ভাবে বর্ণনা করা যাবে না। ইট চাপা ঘাসের মতো স্মৃতি গুলো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। দৃষ্টি শক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে, যাদের কথা লিখবো তারা আজ অনেক ব্যাথা নিয়ে,অনেক অসম্মান নিয়ে “উদ্বাস্তু” হয়ে জীবন সংগ্রাম করে এই ধূলিরুক্ষ পৃথিবী থেকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছে।তাদের দীর্ঘশ্বাস প্রতি নিয়ত আমাকে দহন করে, আমাকে ভাবিয়ে তোলে? মনে হয় “এ আজাদী ঝুটা হ্যায়”।তাই নিষ্ফল চেষ্টা জেনেও বড়দের মুখে শোনা ও জমাকৃত মনের বোঝার ভার কিছুটা লাঘব করার জন্য এই লেখা। পূর্ব পুরুষের কাছে এ আমার দায়বদ্ধতা।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে অবিভক্ত নদীয়ার মহকুমা ছিল পাঁচটি। কৃষ্ণনগর সদর, রানাঘাট, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর। ১৯৪৭ সালের ১২ই আগস্ট রাতে রেডিওতে ঘোষণা করা হলো ভারতবর্ষকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে। আরও বলা হলো নদীয়া জেলা পূর্ব বাংলার মধ্যে পড়েছে। একথা শোনার পর ভারতপন্থী প্রাদেশিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের সম্মানিত রাণী সহ নানা স্তরের সামাজিক ব্যক্তিত্ব ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুরকে ভারতের অংশ হিসাবে অবিভক্ত রাখার জোর দাবী জানতে থাকে।তাদের তৎপরতায় এ দাবী প্রাদেশিক পরিষদ ছেড়ে কেন্দ্রে পর্যন্ত হৈচৈ ফেলে দেয়।১৯৪৭ সালের১৫ই আগষ্ট সমগ্র ভারত যখন স্বাধীনতা দিবস পালন করেছে, তখনও নদীয়াবাসী জানে না তারা ভারত না পাকিস্তানের অধিবাসী। তাদের পতাকা “চাঁদ-তারা সবুজ” না “তিন রঙা অশোক চক্র”। ১৭ই আগস্ট নূতন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জানানো হয় নদীয়ার রানাঘাট ও কৃষ্ণ নগর ভারতের মধ্যে পড়েছে, আর কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ও মেহেরপুর পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনটি বিনিদ্র রাত কাটিয়ে অবশেষে ভারত ভুক্তির মাধ্যমে ১৮ই আগস্ট নদীয়াবাসী স্বাধীনতা লাভ করে। তিন দিন পাকিস্তান থাকার পর কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা,মেহেরপুর বাদ দিয়ে নদীয়া (কৃষ্ণনগর) আবার ভারতের অংশ হয়ে গেল। এ যেন ছেলের হাতের মোয়া? ইচ্ছে হল দিলাম ইচ্ছে হল কেড়ে নিলাম। কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হলো। এ যেন সিরাজুদ্দৌলার মুর্শিদাবাদ পতন। নদীয়ার অঙ্গচ্ছেদ হ’ল। কৃষ্ণ নগরে বসবাসরত হিন্দুদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। তারা মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিল; নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করলো আর রাস্তায় রাস্তায় মিছিল মিটিংয়ে করে তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।মুসলমানেরা প্রথমে হকচকিয়ে বোবা হয়ে গেল। মনে হল তাদের পায়ের মাটি দুর্বৃত্তরা কেড়ে নিল।তাদের মন ভেঙে গেল।চোখের পানি শুকিয়ে গেল। এ যেন নিজ ঘরে প্রবাসী!! তারা চোখের সামনে চির পরিচিতদের বিভৎস কুৎসিত চেহারা দেখে চমকে উঠলো।স্থানীয় হিন্দু, যাদের সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী আপন আত্মীয়ের মত বাস করে এসেছে, একই দেশমাতৃকার জানুর উপর বসে স্নেহ মায়া মমতা, ভালোবাসা ভাগ করে নিয়েছে আজ সেই ভাতৃপ্রতিম হিন্দুদের বিদ্বেষ, ঘৃণা নীচতা দেখে তারা হতবাক, হতবিহ্বল, হতভম্বিত হয়ে পড়লো।১৮৫৭ সালে হিন্দু মুসলমান, শিখ যৌথ ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে “স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম” করেছে, মোঘল আমলের প্রায় চারশো বছর, টিপু সুলতানের শাসনামলে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে মুসলমানেরা দেশ শাসন করেছে। দীর্ঘ চারশো বছরে হিন্দুদের মুসলমান করার চিন্তা করা হয়নি। বরং হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ঐক্য প্রক্রিয়া জোরদারের লক্ষ্যে সম্রাট আকবর “দীন ই এলাহি” নামে এক নূতন ধর্মের প্রবর্তনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা নির্বিশেষে যার যার উপাসনালয়ে প্রার্থনা করেছে, তাদের উপাসনার ভিন্নতা ছিল কিন্তু বৈরীতা ছিল না। হিন্দুরা জানতো না মুসলমানেরা দিনে কতবার নামাজ আদায় করে আর মুসলমানেরাও যানতো না হিন্দুদের “বার মাসে তের পাবনের” কথা অথচ এই ধর্মের উপর ভিত্তি করেই দেশ বিভাজন হ’ল এবং আকাশে বাতাসে সাম্প্রদায়িক বিষ বাষ্প আণবিক বোমার মত ছড়িয়ে পড়লো।

আমাদের বাড়ীর দলিজ ঘরে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে বারবার গোপন মিটিং হতে লাগলো। কেউ দেশত্যাগের পক্ষে,কেউ বিপক্ষে মত ব্যক্ত করছেন।তবে বেশীর ভাগ মুরুব্বীদের অভিমত তারা এদেশের ভূমিপুত্র, তারা এ মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছে, এখানকার আলো বাতাসে বড় হয়েছেন তাদের পূর্বপুরুষদের সকলেই এখানে ঘুমিয়ে আছে,তারা ঘর বাড়ীর জমির খাজনা ট্যাক্স দেন, কাজেই জিন্নাহ নেহেরু, দেশ ভাগ যায় করুক না কেন,তারা তাদের জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাছাড়া যে সমস্ত সতীর্থ হিন্দুদের সাথেএতদিন পূজা পার্বণে, খাওয়া দাওয়া চলাফেরা করলো তারা চোখ উলটে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে এমনটিও তারা প্রত্যাশা করেন না।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি হল ভিন্ন।একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো। সন্ধ্যার পর রাস্তা ঘাট ফাঁকা হয়ে গেল।মাঝরাতে কুকুর শেয়ালের ডাকের সাথে মানুষের আর্তনাদ আমাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুললো। প্রতিদিন নিত্য নূতন গুজব মুসলমানদের মনোবলকে গুড়িয়ে দিতে লাগলো।ঘরের ভিতরের ও বাইরের দরজাকে আরও মজবুত করা হ। নতুন করে হুরকো লাগানো হল।বাড়ির বউঝি, মেয়েদের বাইরে যাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেল।চাচারা সবসময় সন্ত্রস্ত থাকেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে হিন্দুদের অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে পূর্ব বঙ্গ হতে আগত হিন্দু উদবাস্তুের উপর অত্যাচারের কল্পিত গুজবের সংবাদ আগুনে পেট্রোল ঢালার মত অবস্থার সৃষ্টি করলো।বহু আপনজনই না জানিয়ে গোপনে সম্পত্তি বিনিময় করে পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি দিলেন। এমনকি নিজেদের মধ্যও ক্রমশ অবিশ্বাস,সন্দেহ দানা বিধে উঠলো। আমরা যারা,মাতৃভূমি ছাড়ার বিপক্ষে ছিলাম,তারা সংখ্যা লঘু হয়ে পরলাম। আমাদের মনোবল ভেঙে যেতে লাগলো। অনেক হিন্দু দালাল বাড়ী বেচার জন্য প্ররোচনা দিতে লাগল। আবার আমরা যেন বাড়ি না বেঁচে ভয়ে বাড়ি ফেলে পালিয়ে আসি সে ব্যবস্ঠাও গোপনে চলতে লাগল। সব মিলে পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠলো। পরিশেষে আমরা বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। অনেক আলাপ আলোচনা পরে সিদ্ধান্ত হল সোনা দানা ছাড়া তেমন কিছুই সঙ্গে নেওয়া যাবে না;পথে লুট হয়ে যেতে পারে।বাড়িতে ন’ চাচা থাকবেন উনি পরে সুবিধা মত সময়ে টাকাপয়সা পাঠিয়ে দেবেন। সম্পত্তির বন্দোবস্ত করে উনি পাকিস্তানে আসবেন।
সেই সময়ের কথা চিন্তা করা যায় না। দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। দুঃখের দিন রাত সহজে কাটে না। কোন জিনিস সঙ্গে আনতে পারবে না জেনেও সব গোছগাছ করা হলো। গরুর গলাধরে চাচীর কি কান্না!!সারারাত নেহেরু জিন্নাহকে শাপশাপান্ত করলো। চাচার বকা খেতে খেতে সারারাত কান্নাকাটি করে মাত্র দুই তিনটা তোরঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অতি প্রত্যুষে চোখের পানি মুছতে মুছতে অতি আদরের, অতি ভালবাসার বাড়ি ঘর গোয়াল, ধানের গোলা,চির পরিচিত জন্মভূমি ছেড়ে আমরা অজানা অচেনা পথে বার হলাম।যাঁরা কখনো এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি ঘোড়ারগাড়ি ছাড়া হেঁটে যায়নি, তারা আজ পুটলা পুটলি তোরঙ্গ নিয়ে পদব্রজে অজানার উদ্দেশ্য বার হ’ল। পিছনে পড়ে থাকলো ঘর বাড়ী,
ভিটামাটি, সুখ দুঃখের সোনালী অতীত। এ স্বজন হারাদের দুঃখ কষ্ট জিন্নাহ নেহেরুরা বুঝেনি, বুঝবেও না; ভবিষ্যতের কর্ণধাররাও বুঝবে না।
কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষ দংশনি যারে।
( চলবে)

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।