আরিফ হোসেন নিশির ::
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” (International Labour Day) একটি স্মরণীয় অধ্যায়। হাজার হাজার শ্রমিকদের আপোষহীন সংগ্রামের কথা বলে শ্রমিক দিবস। আন্তর্জাতিক কর্মী দিবস বা শ্রমিক দিবস ১লা মে-তে পালিত হয়। এই কারণে দিনটি “মে দিবস” নামেও পরিচিত।
শ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। একটি দেশ গড়ে তোলার পিছনে থাকে সেই দেশের মানুষদের তথা শ্রমিকদের কঠিন পরিশ্রম। শ্রমিকগোষ্ঠীর কঠোর পরিশ্রম এবং কৃতিত্বগুলির উদযাপনের দিন হল শ্রমিক দিবস। এই দিনবিশ্বজুড়ে সমগ্র শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্রত নিয়েছিল।
বিশ্বের অনেক দেশেই ‘মে ডে’ পরিচিত প্রাচীন এক বসন্তের উৎসব হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে এটা বেশি পরিচিত শ্রম দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও অর্জনের কথা মনে করিয়ে দিতেই দিনটি পালিত হয়ে থাকে।
প্রতি বছর কাজের পরিবেশ আরও ভালো করা এবং ট্রেড ইউনিয়নকে আরও শক্তিশালী করার দাবিতে বিশ্বজুড়ে এদিন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি হতে দেখা যায়।
শুরুর দিকে এই দিবসটি বিভিন্ন সামাজিক ও সমাজতান্ত্রিক সংস্থা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো পালন করতো।
যদিও এই দিবসের পেছনের আসল প্রতিবাদটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু সেখানে এটি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার পালন করা হয়ে থাকে।
শ্রমিক দিবসের প্রতিষ্ঠাতা
শ্রমিক দিবসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন পিটার জে. ম্যাকগুয়ের।
ভারতে প্রথম মে দিবস কোথায় পালিত হয়?
ভারতে প্রথম শ্রম দিবস বা মে দিবসটি ১৯২৩ সালে চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ) মে দিবস উদযাপনের জন্য শ্রম কিষণ পার্টি কর্তৃক পালিত হয়েছিল।
যেভাবে এর শুরু
১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েনের এক চিন্তা থেকে, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এক বিরাট প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে।
রবার্ট ওয়েন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি পূরণে স্লোগান ঠিক করেন, ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রাম’।
সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা হয় পহেলা মে শিকাগোতে, যেখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক সমবেত হন।
সে সময় কারখানায় কোন নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা বা বিশ্রাম ছাড়াই টানা কাজ করে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। আর সেসময় শিকাগো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকারখানা ও ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর কেন্দ্র।
পরবর্তী কয়েক দিনে এই আন্দোলনকে ব্যবসায়ী ও রাজনীতি মহল পছন্দ না করলেও, আরও হাজার হাজার ক্ষুব্ধ শ্রমিক ও আন্দোলনকারী এতে যুক্ত হতে থাকেন।
এ সময় কিছু নৈরাজ্যবাদীও এতে যোগ দেন যারা কোন রকম নিয়ম ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক কাঠামো স্বীকার করেন না।
উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়, একজন মারা যায় ও অনেকে আহত হয়।
পুলিশি নিষ্ঠুরতায় ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত বিক্ষোভকারী এবং শ্রমিক নেতারা পরদিন ৪ই মে শিকাগোর বিখ্যাত হেমার্কেট স্কয়ারে কর্মসূচির ডাক দেয়।
এ সময় আজও পরিচয় জানতে না পারা এক ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়েন।
ওই বিস্ফোরণের ফলে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সাতজন পুলিশ সদস্য নিহত হয় এবং ৬৭ জন কর্মকর্তা আহত হয়। চারজন বিক্ষোভকারীও নিহত হয় এবং ৩০ জনেরও বেশি আহত হয়।
এই ঘটনা পরে পরিচিতি পায় হে মার্কেট ম্যাসাকার হিসেবে। পরবর্তীতে আট জন নৈরাজ্যবাদী খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তাদের দোষ ঠিকভাবে প্রমাণের আগেই তাদের অনেককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
এই ঘটনাগুলোর স্মরণে, ১৮৮৯ সালে ২০ দেশের সমাজকর্মী, শ্রমিক নেতা ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে পহেলা মে তারিখ ‘মে দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মে দিবস পালনে যোগ দেয় অন্য দেশ
শিকাগোর এই সংঘাত পরবর্তী কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলোর জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে থাকে।
দক্ষিণ ইউরোপে প্রথম মে দিবস পালনে এগিয়ে আসে স্লোভেনিয়ান এবং ক্রোয়াটরা, যারা সেসময় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কাজের নিচু পরিবেশ, অল্প বেতন এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রতিবাদে ১৮৯৩ সালে সার্বিয়ার শ্রমিকরা এক মে দিবস র্যালি বের করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দ্রুত শিল্প কারখানায় উন্নতি ঘটতে থাকে, তখন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরও বিশ্বজুড়ে শ্রমিকরা মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করতে থাকে।
জার্মানিতে ১৯৩৩ সালে নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিক দিবসের দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
একইসাথে এই ছুটি ঘোষণার সাথে সাথে ফ্রি ইউনিয়ন তুলে দেয়া হয় এবং জার্মান শ্রমিক আন্দোলনও থামিয়ে দেয়া হয় । যদিও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আবারও ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়।
পূর্ব এবং পশ্চিম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের পর বৈশ্বিক মানচিত্র বদলে যায়। বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভক্তি বেশি করে চোখে পড়তে থাকে।
বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ যেমন কিউবা, সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনে বছরের পর শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে এসেছে এবং এ দিনের ছুটিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়।
সাধারণত এদিন বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হত, যেমনটা মস্কোর রেড স্কয়ারে দেখা যেত। সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিরা যোগ দিতেন।
এদিন একইসাথে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর শক্তিমত্তাও প্রদর্শন করা হত।
সমাজতান্ত্রিক নেতারা বিশ্বাস করতেন এই নতুন ঘোষিত ছুটি ও উৎসব ইউরোপ এবং আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণীকেও উদ্বুদ্ধ করবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াইয়ে।
সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক অফ যুগোশ্লাভিয়ার গল্পটাও ছিল একই রকম।
সেখানে ১৯৪৫ সাল থেকে মে দিবসের দিন সরকারি ছুটি পালিত হয়ে আসছে। দিনটি উদযাপনে মিছিল ও সামরিক র্যালি অনুষ্ঠিত হয় এবং একইসাথে রাষ্ট্রীয় প্রচারণার জন্য বেছে নেয়া হয় দিনটিকে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে শ্রমিক ও ইউনিয়নগুলি আরও ভালো কাজের পরিবেশের দাবিতে মে দিবস ঘিরে র্যালি ও সমাবেশ করে।
বেকারত্ব ও দারিদ্র্যতার সাথে লড়াইয়ে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনো গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে।
বেকারত্ব কমলেও এবং কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসলেও, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন – আইএলও তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলছে, বেশিরভাগ জি-২০ দেশে গত বছরের মুদ্রাস্ফীতির সাথে তাল রেখে মূল বেতন ভাতা দিতে পারে নি।
আইএলও বলছে, গত বছর ক্রয়ক্ষমতা (পিপিপি) অনুযায়ী চরম দারিদ্রসীমায় থাকা শ্রমিক যাদের আয় দিনে ২.১৫ ডলারেরও কম, তাদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ বেড়ে গিয়েছে।
আর সহনীয় দারিদ্র্য সীমায় থাকা শ্রমিকের সংখ্যা (ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী যারা দিনে ৩.৬৫ ডলারের কম আয় করেন) বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮৪ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে আইএলও।
ভারতে শ্রমিক দিবস পালন
ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ১৯২৩ সালে হিন্দুস্তান শ্রমিক কিষান পার্টি দ্বারা মাদ্রাস-এ (বর্তমানে চেন্নাই) শ্রমিক দিবস পালিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে ১লা মে সর্বপ্রথম শ্রমিক দিবসের প্রতীক হিসেবে লাল পতাকা উত্তেলিত হয়েছিল।
কমরেড সিঙ্গারাভেলর (মালায়াপুরম সিঙ্গারাভেলু চেটটিয়ার) শ্রমিক দিবস উদযাপনের আয়োজক ছিলেন। সিঙ্গারাভেলর ছিলেন মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির অন্যতম নেতা। তিনি পিছিয়ে পড়া শ্রেণীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছিলেন।
প্রথম শ্রমিক দিবসে ত্রিপিলিকেন সমুদ্রসৈকত এবং মাদ্রাস হাই কোর্ট-এর বিপরীতে দুটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সভায় সিঙ্গারাভেলর, মে দিবস বা শ্রমিক দিবসকে সরকারী ছুটি ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন। ভারতবর্ষে আজও এই দিনটি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে পালিত হয়।
বর্তমানে ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বিভিন্ন জনসভায় শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিষয়ে বক্তৃতা দেন। জনসভা, আলোচনাসভা, শোভাযাত্রা, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রমিক দিবস পালিত হয়।
বাংলাদেশে শ্রমিক দিবস পালন
বাংলাদেশে শ্রমিক দিবস পয়লা মে-তে পালন করা হয়। এই দিনটিতে বাংলাদেশে সরকারী ছুটি থাকে।
শ্রমিক দিবসে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। শিকাগোর শ্রম আন্দোলনের স্মৃতিচারণের জন্য সভা, সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। রেডিও, টেলিভিশনে শ্রমিক দিবস সম্বন্ধে আলোচনা এবং কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করা হয়।
শ্রমিকরা নানা রঙের ফেস্টুন এবং মাথায় রং বেরঙের কাপড় বেঁধে শোভাযাত্রা বের করেন। তারা অতীতের সংগ্রামের বিজয় উদযাপন করেন এই শোভাযাত্রা এবং মিছিলের মাধ্যমে।
# লেখক আরিফ হোসেন নিশির সম্পাদক ও প্রকাশক