অমিতাভ কাঞ্চন ::::
সম্প্রতি প্রকাশিত জিএসএমএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ফাইভজি নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী ছিল শূন্যের কোটায়। এ সময় ফোরজি নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীর হার ছিল ৪৬, থ্রিজি নেটওয়ার্কের ১৬ ও টুজির ৩৮ শতাংশ। দেশে ২০৩০ সালেও সবচেয়ে বেশি থাকবে ফোরজি নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী, ৭৩ শতাংশ। এছাড়া ২ শতাংশ টুজি ও ৩ শতাংশ গ্রাহক ব্যবহার করবে থ্রিজি নেটওয়ার্ক। পঞ্চম প্রজন্মের ব্যবহারকারীর হার বেড়ে দাঁড়াবে কেবল ২২ শতাংশে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও তখন প্রায় অর্ধেক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী থাকবে ফাইভজি নেটওয়ার্কের আওতায়। দেশের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় ফাইভজি প্রসারের ধীরগতির কারণ হিসেবে টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের ব্যক্তিগত ব্যবহারের দিক থেকে ফাইভজি বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না। মানুষের প্রয়োজন আসলে ফোরজি। তাই সেলফোন অপারেটররা ফাইভজি খাতে তুলনামূলক ধীরগতিতে বিনিয়োগ করতে পারে। তেমনটা হলে জিএসএমএ প্রাক্কলনের চেয়েও কম গ্রাহক সংযুক্ত হবে পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্কে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে বেশির ভাগ কার্যক্রম ফোরজি দিয়েই করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু আমরা উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগের কথা বলছি, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, তার জন্য ফাইভজির কোনো বিকল্প নেই। তা গ্রাহক পর্যায়ে কতটুকু সাড়া ফেলবে তার ওপর নির্ভর করবে আগামীতে এর বিস্তার কতটুকু সম্ভব হবে।’
ফাইভজি চালু করতে অপারেটরদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলো চাইবে নতুন বিনিয়োগ না করতে, ফোরজি দিয়েই যদি কার্যক্রম চালানো যায়, তাহলে তারা ওই নেটওয়ার্কে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে। কিন্তু ফোরজি দিয়ে সব সেবা দেয়া সম্ভব হবে না। এর জন্য ফাইভজি লাগবে, যত বিনিয়োগই লাগুক না কেন ফাইভজি নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য বিটিআরসি বা যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদেরও অপারেটরদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’
জিএসএমএ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতে ২০৩০ সালে ফাইভজি ব্যবহারকারীর হার দাঁড়াবে ৪১ শতাংশে। ওই সয়ম দেশটিতে ৫৬ শতাংশ ফোরজি ও ৩ শতাংশ টুজি ব্যবহারকারী থাকবে। নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে কেবল পাকিস্তান। দেশটিতে ২০৩০ সালে ফাইভজি ব্যবহারকারী বেড়ে দাঁড়াবে কেবল ১০ শতাংশ। ৮০ শতাংশ গ্রাহকই থাকবে ফোরজি ব্যবহারকারী। ফাইভজি ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী হবে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান ও মালয়েশিয়া। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯৫ শতাংশ ফাইভজি ও ৫ শতাংশ ফোরজি গ্রাহক থাকবে ওই সময়ে। সিঙ্গাপুরে ফোরজি গ্রাহক কমে ৫ শতাংশে এবং ফাইভজি গ্রাহক বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ শতাংশে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের টেলিকম খাতের আয় ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বলে জিএসএমএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেলফোন অপারেটরদের আয়, প্রতিযোগিতামূলক সেবা প্রদান, সেবায় বৈচিত্র্য আনয়নের মতো কার্যক্রমের মাধ্যমে ডাটা সেবায় এসেছে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি।
আইসিটি এন্ড সফটওয়্যার ও অনলাইন কনটেন্ট ক্রিয়েটর ইনস্টিটিউটের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও দৈনিক মুক্ত বাংলা সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, ‘ বিশ্ব প্রযুক্তি ফাইভজির বিকল্প ভাবছে আর আমাদের দেশে বেশির ভাগ কার্যক্রম ফোরজি দিয়েই করা সম্ভব হচ্ছে কিন্তু আমি বলি চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগের কথা বলছি, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, তার জন্য অবশ্যই ফাইভজির কোনো বিকল্প নেই। যত দ্রুত আমরা সংযোগ করবো তা গ্রাহক পর্যায়ে অবশ্যই তত দ্রুত সাড়া ফেলবে। যেহেতু পৃথিবী শুধু নয় পাশ্ববর্তী দেশগুলো এ সুবিধার আওতায় এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। প্রয়োজনে গবেষনা করে প্রযুক্তিকে গ্রহন করতে হবে। তবে যদি তার ওপর নির্ভর না করি এভাবেই চালিয়ে নিতে থাকি তাহলে আগামীতে এর বিস্তার কতটুকু সম্ভব হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
তিনি বলেন, ফাইভজি চালু করতে অপারেটরদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে না হলে তারা পথে হাটবে না। পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলো চাইবে নতুন বিনিয়োগ না করতে, ফোরজি দিয়েই যদি কার্যক্রম চালানো যায়, তাহলে তারা ওই নেটওয়ার্কে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে। কিন্তু ফোরজি দিয়ে সব সেবা দেয়া সম্ভব হবে না। এর জন্য ফাইভজি লাগবে, যত বিনিয়োগই লাগুক না কেন ফাইভজি নিয়ে আসতেই হবে। এর জন্য বিটিআরসি বা যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদেরও অপারেটরদের চাপ প্রয়োগ ফাইভ জি আনতে বাধ্য করতে হবে। না হলে আবারও আমরা প্রযুক্তির পিছিয়ে পড়া গলেরপর মধ্যে পড়বো। সাবমেরিন কেবলের মতো আমরা বিনা পয়সা গেটওয়ে নিতে পারবো না। হয়তো আরো বড় সংকটে পড়বো। তাই আগে থেকেই সাবধান।
সেলফোন অপারেটররা বলছে, ফাইভজি সেবার বিধিমালা প্রণয়ন, লাইসেন্স প্রদান, আনুষঙ্গিক খাতে বিনিয়োগে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ হয়েছে। ফাইভজি নিয়ে পাঁচ বছর ধরে নানা আলোচনা চললেও এখন বিনিয়োগে কিছুটা ঝুঁকি মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে সিক্সজিও চলে এসেছে। ফলে এখন ফাইভজিতে বিনিয়োগ করা লাভজনক হবে, না সিক্সজিতে—তা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। ফলে দেশে ফাইভজির সম্প্রসারণ হবে, না সিক্সজির সম্প্রসারণ হবে—তা এখনো নিশ্চিত নয়। এর আগে ওয়ানজি ও থ্রিজিতে বিনিয়োগ করে লোকসান দিতে হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের চিন্তা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে ডিভাইস ইকোসিস্টেম যে অবস্থায় আছে সেখানে ফাইভজি শুরু করতে ১৮-২৪ মাস সময় লাগবে। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ শতাংশের মতো ফাইভজি হ্যান্ডসেট থাকলেও এ প্রযুক্তির বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্র সীমিত হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যবহারকারীর আগ্রহ কম। এছাড়া ফাইভজি চালুর অংশীজনের অনেকেই এখনো প্রস্তুত নয়। আমাদের পুরো প্রস্তুতি রয়েছে তবে ফাইভজি ইকোসিস্টেম উন্নতি না হলে এ সেবা শুরু করতে আরো সময় প্রয়োজন হবে।’
বিটিআরসি বলছে, অপারেটররা যত দ্রুত ফাইভজি সেবা বাস্তবায়ন করবে তত দ্রুত দেশের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় এর প্রসার হবে। গ্রাহকদের উচ্চ মাত্রার ইন্টারনেট সেবা সরবরাহে এরই মধ্যে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বিটিআরসি। এখন অপারেটররা উদ্যোগ নিলেই এ সেবা দ্রুত সম্প্রসারণ হবে। তা না হলে অন্য দেশের তুলনায় বেশ পিছিয়েই থাকতে হবে।
জানতে চাইলে বিটিআরসির কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বিটিআরসির প্রধান কাজ হচ্ছে বাজারে নতুন সেবা নিয়ে আসার জন্য পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। একীভূত লাইসেন্সিং নীতিমালা প্রকাশের মাধ্যমে বিটিআরসি সেটি করেছে। এখন নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের দায়িত্ব অপারেটরদের। নতুন লাইসেন্সের মাধ্যমে অপারেটররা চাইলে ফাইভজি সেবা আনতে পারে, চাইলে সিক্সজিও আনতে পারে। এটা নির্ভর করবে অপারেটরদের ওপর।’
দেশের ফাইভজি সম্প্রসারণে জিএসএমএর প্রাক্কলনের প্রসঙ্গটি সামনে আনলে প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ফাইভজি তো কেবল মানুষ না; মেশিন, রোবট, মেশিন লার্নিং, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার হবে। এর ফলে ফাইভজির ফিচারসংখ্যা বাড়বে এবং এখানে বিনিয়োগের বিপরীতে ভালো ব্যবসা করতে পারবে অপারেটররা। এখন অপারেটররা কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে সেটা তাদের বিষয়, বিটিআরসি সেটি নির্ধারণ করে দেবে না।’