মেহেদী হাসান, আরিফ নিশির, আহমেদ বিন আলম::
রাজধানীর মানিকদী ও মাটিকাটা এলাকায় একচ্ছত্র অধিপতি আব্বাস উদ্দিন। কেউ জমি বিক্রি করতে হলে তা কম মূল্যে কিনে নেন তিনি। এরকম অভিযোগের পাশাপাশি আবার তার পছন্দের জমি কেউ বিক্রি করতে না চাইলে জোর করে তা দখল করেন। এমন অভিযোগের শেষ নেই। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এখানে কেউ জমি বিক্রি বা কিনতে পারেননি। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করেন, তাহলে তাকে এলাকাছাড়া করেন তিনি। শুধু তাই নয়, পছন্দের উপকরণ দিয়ে স্বপ্নের বাড়ি বানানোর সুযোগও নেই কারও! আব্বাসের ‘রাজ্যে’ ভবন নির্মাণ করতে চাইলে তার বাহিনীর লোকজনের কাছ থেকে নিতে হয় ইট, সিমেন্ট ও রড। এসব উপকরণ খুবই নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও কারও ‘রা’ করার উপায় নেই। বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
গত কয়েকদিন ওই এলাকা ঘুরে জানা গেছে আব্বাস বাহিনীর ভয়ংকর সব কর্মকাণ্ডের কথা। আব্বাস ও তার বাহিনীর অপকর্মের বিষয়ে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চান না। যদিও চোখ দেখে বোঝা যায় তারা কিছু বলতে চান।
অতি প্রভাবশালী আর এত সম্পদের মালিক আব্বাস আগে কী করতেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্থানীয় অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে কালবেলা। তারা বলছেন, আব্বাসের বাবা ইব্রাহিম উদ্দিন মালীর কাজ করতেন। সেই সূত্রেই মানিকদী এলাকায় আব্বাসের বসবাস। তার বাবা পরিচিত ছিলেন বাংলা মদ কেনাবেচার জন্য। বাবার অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গোটা মানিকদী, পল্লবী, নামাপাড়া এলাকায় আব্বাস পরিচিতি পান ‘বাংলা আব্বাস’ হিসেবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও জড়ান তিনি।
শুরুতে নেতাদের ফুটফরমাশ খাটতেন। এরপর থানা যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে তার ভাগ্যের চাকা খোলে। থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন একবার। রাজনৈতিকভাবেও দলে সিনিয়র নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট এই আব্বাস। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে কমিশনার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরাজিত হন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, দলীয় পদ পাওয়ার পর মানিকদী নামাপাড়ায় তিন রাস্তা এলাকায় একটি ভবনের নিচতলায় বসতেন তিনি। পরে এই জমির মালিককে এলাকাছাড়া করে সেখানে দশতলা ভবন নির্মাণ করেন আব্বাস। সম্প্রতি ছেলের নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন ‘শিশির এন্টারপ্রাইজ’ নামে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের কাজ চলছে।
জমি দখল, চাঁদাবাজি ছাড়াও নিজ দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে মানুষের ওপর প্রকাশ্যে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে এই আব্বাসের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পুলিশসহ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালান তিনি। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, র্যাবপ্রধান, ডিবি ও সিআইডি প্রধানের কাছে আবেদন করেও কেউ প্রতিকার পাচ্ছেন না। এতে তার ত্রাসের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।
মানিকদী ও মাটিকাটার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আব্বাস বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে নানা সেক্টরে দায়িত্ব পালন করছেন আজমত আলী, মো. ফারুক, নাজিম উদ্দিন, মো. শাহারিয়ার (রাসেল), নাসির, দোলন, শিবলী ও সুমন। তাদের কেউ থানা পুলিশ ম্যানেজ করে, কেউ হুমকি দেওয়ার দায়িত্বে, কেউ আবার টার্গেট ব্যক্তিকে ধরে এনে নির্যাতনের দায়িত্বে থাকে। এসবের বাইরেও অর্ধশত ক্যাডার রয়েছে তার।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, থানা পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেন আব্বাস। যে কারণে জমি দখলে গিয়ে আইনি জটিলতায় পড়তে হয় না। নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমি কেনা, বাড়ি তৈরি করতে গেলেই এই আব্বাস বাহিনীকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। চাঁদা না দিলে মাদক দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও আছে।
জোয়ারসাহারা মৌজায় ১৩ শতাংশ জমি কিনেছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আবুল বাশার। তিনি কালবেলাকে বলেন, ২০১৮ সালে আব্বাস আমার জমি দখল করছে। ২০১৯ সালে আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা এনেছিলাম। কিন্তু সে কোনো কিছুরই পরোয়া করে না। ক্যান্টনমেন্ট থানার সাবেক ওসি শাহনেওয়াজ ছিল আব্বাসের কাছের লোক। ওরা আমার জমিতে ৯ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করে শেয়ারে বিক্রি করে দিয়েছে। যদিও জমি নিয়ে এখনো মামলা চলছে। আমি এখনো বিচারের আশায় বসে আছি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিংয়ে দায়িত্বরত লিটন উদ্দিন বলেন, জোয়ারসাহারা মৌজায় তার প্রায় ১০০ শতাংশ পৈতৃক জমি ছিল। কিন্তু আব্বাস বাহিনী সেগুলো দখল করে রেখেছে। আমরা ওই জায়গায় গেলে বলে, এখানে আমাদের জমি নেই! তাদের কিছুই বলা যায় না। লোকজন দিয়ে হুমকি দেয়। থানায় অভিযোগ দিয়েও কাজ হয় না। থানার লোকজন সব তাদের ম্যানেজ করা। জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে ২০১২ সাল থেকে।
সম্প্রতি জমি কিনতে গিয়ে ভুক্তভোগী হয়েছেন পারভীন নামে একজন। উপায়ান্তুর না পেয়ে গত ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডিএমপি কমিশনার ও ভূমি সচিব বরাবর অভিযোগ করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আব্বাসের হয়ে দক্ষিণ মানিকদীতে মাদক ব্যবসা চালায় শাহারিয়ার রাসেলের ছোট ভাই রনি। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন বিক্রি করে রনি ও তার লোকজন। পূর্ব মানিকদীতে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন গালকাটা মাসুদ ও নাসির ওরফে সুন্দর নাসির। সে আব্বাসের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত।
ইসিবি চত্বর থেকে বাউনিয়া কালীবাড়ী পর্যন্ত রয়েছে অবৈধ অটোরিকশার চলাচল। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আব্বাস সেগুলো চালানোর ব্যবস্থা করেছেন। বিনিময়ে চাঁদা দিতে হয় তাকে। প্রতি অটোরিকশা থেকে দিনে ১০০ টাকা করে চাঁদা তোলে লাইনম্যান মোস্তফা ও বাবুল। চাঁদা তোলার কাজটি আব্বাসের হয়ে সমন্বয় করে বাবুল।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্মাণকাজে চাঁদাবাজি, জমি দখল, মানুষকে হুমকি দিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করা—এসব হয় গালকাটা মাসুদের নেতৃত্বে। এ কাজে রাসেল, নাসির ও বাবুল যুক্ত থাকে।
বিএনপি-জামায়াতের হয়ে যেসব লোক জ্বালাও-পোড়াও করত, তাদের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনে পুনর্বাসন করার অভিযোগও রয়েছে আব্বাসের বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদ করায় গত ৩ আগস্ট ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য শফিকুল ইসলাম লাল মিয়াকে মেরে হাত ভেঙে দেয় আব্বাস বাহিনী। এ সময় ঘটনাস্থলে আব্বাস উপস্থিত ছিলেন। স্বামীকে হামলা থেকে বাঁচাতে গিয়ে মারধরের শিকার হন লাল মিয়ার স্ত্রীও।
লাল মিয়া কালবেলাকে বলেন, অস্ত্রসহ গালাকাটা মাসুদকে র্যাব ধরেছে। সে করত যুবদল। রাসেলও বিএনপির রাজনীতি করত। এর প্রতিবাদ করাই আমার কাল হয়েছে। আব্বাস তার লোকজন নিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে এনে সবার সামনে আমাকে মারধর করে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় আব্বাসের সঙ্গে। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব মিথ্যা। লাল মিয়া দলের ছেলে ছিল, তাকে দল থেকে দূরে রাখা হইছে। বাশার আমার কাছ থেকে জমি নিয়ে টাকা দেয়নি। হাইয়ের সঙ্গে ওর ঝামেলা। আমি রাজনীতি করি, ব্যবসা করি, প্রতিপক্ষ আমাকে ফাঁসানোর জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ করছে।
ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহিনুর রহমান বলেন, আমি এই থানায় এসেছি চার মাস। এই সময়ে আব্বাসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। আগের কোনো মামলা আছে কি না, তা জেনে নিতে হবে। তার অপরাধ নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।